মেধা পাচার রোধে 'ট্যালেন্ট হান্ট পুল' গঠন এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ

বাংলাদেশে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা: সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ক সেমিনার আজ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড এসএমএএ ফায়েজ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোঃ রেজাউল করিম, পিএইচডি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. এএসএম আমানুল্লাহ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড সাঈদ ফেরদৌস, বারডেম হাসপাতালের প্রফেসর ও ডায়াবেটিক সোসাইটির সভাপতি ড একে আজাদ খান।
আরও পড়ুন: এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষের অধিকার কখনো ক্ষুণ্ণ হবে না: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
সেমিনারে 'ট্যালেন্ট হান্ট পুল' গঠন করে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশবিদেশে উন্নত শিক্ষা প্রদান করে পুনরায় নিজ দেশে ফিরিয়ে এনে কাজে লাগাবার পরামর্শ দেন বক্তারা। তারা বলেন, সময়ের চাহিদা মেটাতে চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম সকল স্তরে চালু করতে হবে। তাহলেই জনসংখ্যাধিক্যের সুফল পেতে পারে বাংলাদেশ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড এসএমএ ফায়েজ বলেন, চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষা প্রকৃতই বর্তমান সময়ের চাহিদা। কর্মমুখী বিশেষায়িত শিক্ষাই দেশের বিপুল তরুণ প্রজন্মকে জনসম্পদে রুপান্তর করতে পারে। তিনি বলেন, কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার প্রতি সমাজের কোনো প্রকার অবজ্ঞা সমীচীন নয়। চাকরি, গবেষণা, প্রকৌশল, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি সকল বিষয়েই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুছানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন প্রফেসর ফায়েজ।
আরও পড়ুন: চাঁদাবাজদের ঠাঁই হবে না বাংলাদেশে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সভাপতির বক্তৃতায় প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলন প্রশ্ন করেন, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা কি শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করছে?
তিনি বলেন, তাদের দক্ষতা উন্নয়ন না হওয়ায় বেকার হয়ে ঘুরছে, জাতির মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষতা উন্নয়ন ব্যতিরেকে যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে, তাদের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, শিল্পের সাথে শিক্ষার সংযোগ ঘটাতে হবে। উন্নত দেশগুলো শিক্ষার্থীদের চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা প্রদান করেই উন্নত হয়েছে। যেসব শিক্ষা বর্তমান বিশ্বে সময়োপযোগী ও চাহিদাসম্পন্ন তা চিহ্নিত করে শিক্ষা কারিকুলাম বিন্যাস করতে হবে। এ সময় তিনি উন্নত দেশসহ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার শিক্ষা কৌশল আলোকপাত করে, কিভাবে তারা মেধা পাচার প্রতিরোধ করেছেন, তার কৌশল শিক্ষানীতিতে যুক্ত করার সুপারিশ করেন।
বিশেষত 'ট্যালেন্ট হান্ট পুল' গঠন করে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশবিদেশে উন্নত শিক্ষা প্রদান করে পুনরায় নিজ দেশে ফিরিয়ে এনে কাজে লাগাবার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ দেখাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত দক্ষতা উন্নয়ন সিলেবাস চালুর শুপারিশ করেন তিনি। সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন জনাব মিলন। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমেই অধিক জনসংখ্যার সুবিধা নিতে পারে বাংলাদেশ। নতুবা এ বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা অদূর ভবিষ্যতে ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই) এর সদস্য সচিব সৈয়দ রেজাউনুল কবির।
স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, উত্তম রাষ্ট্র বিনির্মানে প্রফেশনাল ও সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান।
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, গুণগত শিক্ষাই শিক্ষার বড় সমস্যা। প্রতিবছর এসএসসিতে ২.৫ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ পাঁচ পাচ্ছে। কিন্তু এতে বাস্তব শিক্ষার কোনো উন্নতি হয় কি? দশ লাখ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষা দেয়। যারা জিপিএ পাঁচ পায় না তারা কোথায় যায় -এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ১১ শতাংশ ডিগ্রি পাশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৪.৫ শতাংশ বেকার। তাই জব মার্কেট চাহিদা অনুযায়ী নতুন প্রজন্মকে শিক্ষি করে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। মূল দায়িত্ব পালন করেছে চীন, রাশিয়া ও জাপানের প্রকৌশলীরা। কিন্তু লোকাল প্রকৌশলীরা প্রকৌশলের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়ে লেখা পড়া করেছে। মূল সমস্যা হলো চাহিদা ভিত্তিক শিক্ষার অভাব।
বাংলাদেশের অনুধাবন করতে হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোন্ ধরনের লেখা পড়ার চাহিদা রয়েছে। তার আলোকে শিক্ষার সকল স্তরে কারিকুলাম বিন্যাস করতে হবে। গবেষণা ও ল্যাবওয়ার্ক কাজে আরও মনোনিবেশ করতে হবে। উচ্চতর গবেষণায় বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণ বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে নেপাল ভুটানের মত দেশগুলো।
মূল প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে ধনী গরিবের ব্যবধান, লোকালয়ের ব্যবধান শিক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সামাজিক মূল্যবোধের অবনমন শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। শিক্ষকরা জাতীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে মোটেই প্রশিক্ষিত নন। স্কিল ছাড়া ডিগ্রি জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে না।
কারিগরি ও বাস্তব শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে বেকার সমস্যার সমাধানে। আন্তর্জাতিক কোলাবরেশনের উপর জোর দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা লাভের অধিকারে লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। জাতীয় মূল্যবোধের মানমাত্রা নির্ধারণ করে তার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। জিপিএ পাঁচ এর চেয়ে শিক্ষার্থীদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার কারিকুলাম বিন্যাস করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, গর্ব করার মত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ এখনো করতে পারেনি। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আসতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে তৃতীয় সারিতে বসে থাকলে মাথা উঁচু করার মত শিক্ষক সমাজ পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর প্রায় দশ লাখ গ্রেজুয়েট বের হচ্ছে। এর চল্লিশ ভাগ কোন না কোন কাজে যুক্ত হতে পারছে, বিশ ভাগ স্ব-উদ্ভাবিত কর্মসংস্থান করেছে, অবশিষ্ট চল্লিশ ভাগ বেকার থাকছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ল্যাব, ডেমোনেস্ট্রেটর, শিক্ষক, অধ্যক্ষ সবই থাকা সত্বেও ল্যাব প্রাকটিক্যাল হচ্ছে না। এটা শুধু নৈতিক অবক্ষয়ের অবনমন। এর উত্তরণ ঘটাতে হবে। বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক প্রেরণ নিরুৎসাহিত করতে হবে, তাদের দক্ষ শ্রমিক করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় সেরা শিক্ষক সম্মাননা ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষাকারীকে না দিয়ে প্রকৃতই সেরা শিক্ষককে দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড সাঈদ ফেরদৌস বলেন, এমএ, এসএসসি সার্টিফিকেটের তুলনায় কর্মমুখী শিক্ষার দিকে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে।