সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলে অনিশ্চয়তা, হতাশ পর্যটকরা!

Sanchoy Biswas
হাবিবুর রহমান সোহেল, কক্সবাজার
প্রকাশিত: ৬:২৫ অপরাহ্ন, ০২ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৬:২৫ অপরাহ্ন, ০২ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ নিয়ে পর্যটন শিল্পে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি বিধিনিষেধের আলোকে ৯ মাস বন্ধ থাকার পর শনিবার (১ নভেম্বর) থেকে উন্মুক্ত হয়েছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কথা ছিল, ১ নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হবে। কিন্তু নানা কারণে নভেম্বরে জাহাজ চলাচল করছে না।

জাহাজ মালিকরা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—কেন এমন সিদ্ধান্ত, আর কেন জাহাজ চলাচল করা যাচ্ছে না?

আরও পড়ুন: শিক্ষকরা কেবল পাঠদান নয়, ভবিষ্যৎ নির্মাণেও ভূমিকা রাখেন: ডুয়েট উপাচার্য

এর উত্তর দিয়েছেন সেন্টমার্টিন রুটের পর্যটকবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর নেতারা। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর জানিয়েছেন, প্রথম কারণ সরকারি সিদ্ধান্তে শর্তের বেড়াজাল।

শর্ত অনুযায়ী নভেম্বরে পর্যটকরা সেন্টমার্টিন গেলেও রাত্রিযাপনের সুযোগ নেই। দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে হবে কক্সবাজার। কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়াস্থ বাঁকখালী নদীর ঘাট থেকে সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে পৌঁছাতে সময় লাগে ৭ থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টা। ফলে দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে জাহাজে সমুদ্রযাত্রায় সময় লাগে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা।

আরও পড়ুন: মুন্সীগঞ্জে আ'লীগ নেতার বোনের বাড়িতে ২৩ তাজা ককটেল উদ্ধার, ভাগ্নিজামাই আটক

জোয়ার-ভাটা ও নিরাপত্তার কারণে সেন্টমার্টিনে পৌঁছে জাহাজ এক ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে পারে না। ফলে ১৫ ঘণ্টার সমুদ্রযাত্রা শেষে মাত্র ১ ঘণ্টার দ্বীপ ভ্রমণে আগ্রহী নন অধিকাংশ পর্যটক।

তিনি জানান, কিছুসংখ্যক পর্যটক দিনে গিয়ে দিনে ফিরতে আগ্রহী। তবে এদের সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ১ থেকে দেড় শত। কিন্তু এত কম যাত্রী নিয়ে জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়। একটি জাহাজে অন্তত সাড়ে ৩ শত যাত্রী না হলে আসা–যাওয়া করা সম্ভব নয়, কারণ খরচ অনেক বেশি।

একটি জাহাজের আসা–যাওয়ার জন্য জ্বালানি, নাবিক, কর্মচারী, ঘাটের টোল, সরকারি ভ্যাটসহ সর্বমোট খরচ প্রায় ১০ লাখ টাকা। ফলে পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চালানো যাচ্ছে না।

অন্যদিকে উখিয়ার ইনানীস্থ নৌবাহিনীর জেটি ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে গেলে সময় কম লাগে। যাওয়া-আসা মিলিয়ে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টায় সম্ভব হয় এবং দ্বীপে আড়াই ঘণ্টা অবস্থানের সুযোগ থাকে। কিন্তু পরিবেশগত কারণে ওই জেটি দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতি নেই।

টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে সময় আরও কম লাগে—যাওয়া-আসা ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। কিন্তু মিয়ানমারের আরাকান আর্মি ও জান্তার সংঘাত, নাফ নদী এলাকায় জেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং গোলাগুলির ঝুঁকির কারণে তা সম্ভব নয়। ফলে জাহাজ মালিকরা নভেম্বরে জাহাজ চলাচল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, “গত বছরের মতো ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাসে জাহাজ চলাচলের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।”

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরের বুকে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। চলতি নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার অনুমতি পাবেন। তবে মানতে হবে সরকারের ১২টি নির্দেশনা।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নভেম্বরে পর্যটকেরা শুধু দিনের বেলায় দ্বীপ ভ্রমণ করতে পারবেন, রাতযাপন নয়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রাতযাপনের সুযোগ থাকবে।

এ ছাড়া পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ১২টি নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে বিআইডব্লিউটিএ এবং মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান সেন্টমার্টিনে যেতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাস পর্যন্ত পর্যটকেরা দ্বীপে যেতে পারবেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার ৯ মাসের জন্য পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকবে।

ভ্রমণকালে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়–বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ক্ষতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সৈকতে মোটরসাইকেল বা সি-বাইক চলাচলও নিষিদ্ধ।

নিষিদ্ধ পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, মিনিপ্যাক সাবান-শ্যাম্পু, ৫০০–১০০০ মিলিলিটারের বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জাহাজ মালিকরা জানান, রাতযাপনের অনুমতি না থাকায় পর্যটকদের আগ্রহ কমে গেছে। প্রথম দিন ‘কর্ণফুলী এক্সপ্রেস’ ও ‘বারো আউলিয়া’ নামে দুটি জাহাজ চালুর কথা থাকলেও পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ায় তা স্থগিত করা হয়েছে।

বিষয়ে সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, “রাত্রিযাপন বন্ধের কারণে পর্যটকদের অনীহা তৈরি হয়েছে। আজও কোনো জাহাজ দ্বীপে আসেনি। ভরা মৌসুমেও পর্যটকশূন্য দ্বীপে হাহাকার চলছে। দ্বীপবাসীর জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।”

তিনি আরও বলেন, “কক্সবাজার থেকে ৭-৮ ঘণ্টা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে একই দিনে ফেরা অসম্ভব। এত কড়াকড়ি করলে পর্যটকেরা সেন্টমার্টিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ পর্যটন খাত থেকে হারিয়ে যেতে পারে।”