বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা: অগ্রগতির জন্য মারাত্মক হুমকি

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা পুনরায় সবচেয়ে প্রলয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জেরূপে আবির্ভূত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য, পারস্পরিক আস্থার সংকট, রাজনৈতিক স্বার্থের প্রাধান্য, হরতাল, অবরোধ, রাস্তায় সহিংসতা এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি কেবল দৈনন্দিন জীবনকে অস্থিতিশীল করছে না, বরং দেশের ভবিষ্যতকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এই ধরনের অস্থিরতা কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি জাতির সামাজিক একতা, আইনশৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
সামাজিক স্থিতিশীলতা সংকটে
আরও পড়ুন: দলবাজের শেকল ভেঙ্গে পেশাদার আমলাতন্ত্র গড়তে সংস্কারের রূপরেখা
বাংলাদেশে অস্থিরতার মূল কারণ হলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে জনগণের আস্থা ক্ষয়। জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে, এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা , বত’মান অন্তর্বর্তী কালীন সরকারকে অকার্যকর করার জন্য অসহযোগিতা করা এবং অকার্যকর প্রমাণ করার জন্য ইচ্ছাকৃত নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে অস্হিরতা সৃষ্টি করা এবং বিএনপির সঙ্গে অনান্য রাজনৈতিক রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হওয়ায় দেশীয় রাজনৈতিক দৃশ্যপট বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
সমাজ এখন ক্রমাগত ভয়ে বসবাস করছে—স্কুল বারবার বন্ধ হচ্ছে, পরিবহন কার্যক্রম প্রায়ই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষের মনে যে নতুন শুভদিনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তাহা এখন দিন দিন ম্রীয়মান হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে আছে।রাজনৈতিক বড় দলগুলো নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গঠনমূলক প্রয়োজনীয় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্কারে বাধা সৃষ্টি করছে। যাহা বতর্মানে দেশ ও জাতিকে হতাশায় নিমজ্জিত করিতেছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
এই অস্থিরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সম্প্রদায়গত সহিংসতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়, তাদের বাড়ি, ব্যবসা ও মন্দিরে হামলার শিকার হচ্ছে। ইসলামী উগ্রপন্থার প্রভাব, জনসম্মত বিচার ও পাহারাদারি সহিংসতার বৃদ্ধির কারণে সামাজিক সংহতি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঐক্যের পরিবর্তে বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে বিভক্ত।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিপন্ন
বাংলাদেশ গত দুই দশক ধরে প্রতি বছর ৬–৭% হারে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ছিল। তবে ২০২৪–২০২৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই প্রবৃদ্ধির ধারাকে বিপরীতমুখী করেছে।
• FY2024-এ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.২%-এ নেমে গেছে এবং FY2025-এর জন্য এটি ৩.৩% পর্যন্ত নামার আশঙ্কা রয়েছে (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক)।
• এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ২০২৫-এর পূর্বাভাস ৩.৯%-এ নামিয়েছে, কারণ অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
• ব্যক্তিগত বিনিয়োগ জিডিপির ২২.৫%-এ নেমে গেছে, যা গত পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন (DCCI)।
• বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ (FDI) ২০২৪ সালের আগে তুলনায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।
রেডি-মেড গার্মেন্টস (RMG) শিল্প, যা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত, মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবহন ও সরবরাহ চেইনের বিঘ্নে রপ্তানি বিলম্ব হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করেছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে দুই মিলিয়নের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে, যার ফলে পরিবারগুলো আরও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলেছে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রার উৎস, তা হঠাৎ কমে গেছে, অর্থনীতিকে আরও চাপের মধ্যে ফেলেছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দৈনিক মজুরীভোগী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খাদ্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ সংখ্যায় পৌঁছেছে, ফলে লাখ লাখ মানুষ মৌলিক প্রয়োজনীয়তা বঞ্চিত হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা চরম চাপে
রাস্তা আন্দোলন, অগ্নিসংযোগ, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ চালু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে ১১,০০০-এর বেশি গ্রেফতার হয়েছে, যা রাজনৈতিক দমন অভিযোগকে আরও উসকে দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানে জনগণের আস্থা হ্রাস করেছে। অতি সম্প্রতি উপযুক্ত বা যৌক্তিক নিবার্চনের সময় ঘোষণার অনেক আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা প্রশাসনের মধ্যে দলীয়করণ ,দলীয় কোন্দল ও দুর্নীতির বলয় উভয়ই সৃষ্টি করেছে! এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ আমলারা নির্দিষ্ট দলের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মত আচরণ প্রকাশ করেছে!
রাজনৈতিক চএছায়ায় অপরাধী জোটও এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিচ্ছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজী, চুরি ডাকাতি, লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ঘুম খুন , অপহরণ, ধষ’ন, মাদক চোরাচালান এবং সশস্ত্র সহিংসতা ইত্যাদি অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে, স্থানীয় অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করছে এবং নাগরিকদের নিরাপত্তাহীন মনে হচ্ছে। সাংবাদিকরাও অপ্রত্যাশিত দমনভোগ করছেন—১১ মাসে ১০ জন নিহত, ৩৯ জন গ্রেফতার, এবং ১,০০০+ বরখাস্ত হয়েছে—যা স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জাতীয় সংকট আরও গভীর হচ্ছে
রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যদিও সকলের সহযোগিতা করার প্রত্যাশা ছিল কিন্তু উল্টো নানা রাজনৈতিক প্রতিকূলতার স্বীকারে পর্যুদস্ত হয়ে তারা এপ্রিল ২০২৬-এর নির্বাচন প্রস্তাব করেছে, তবে বিএনপি ডিসেম্বর ২০২৫-এর নির্বাচনের দাবি জানায় এবং যাহা পরবর্তীতে বিএনপির দাবীর মুখে ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের জন্য নির্ধারিত হয় , কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবির মুখে অনিশ্চয়তা এখনো বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্ব বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাচ্ছে, আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব ধীর করছে, এবং কূটনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে।
ব্যাংকিং খাতও ভাঙনের উপক্রম। ডিফল্ট ঋণের হার মোট পোর্টফোলিওর ৩০%-এ পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। দেউলিয়াপনা এড়াতে বাংলাদেশ অতিরিক্ত $৭৬২ মিলিয়ন IMF ঋণ চেয়েছে, যা পূর্বের প্রতিশ্রুতির উপরে যোগ হয়—মোট IMF সহায়তা হয়েছে $৪.১ বিলিয়নের বেশি।
২০২৫ সালের NBR ধর্মঘট, যা কাস্টমস ও রাজস্ব কার্যক্রম অচল করে দিয়েছে, দৈনিক প্রায় Tk 2,500 কোটি মূল্যের বাণিজ্য ব্যাহত করেছে। এটি দেখায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সরাসরি অর্থনৈতিক স্থবিরতায় পরিণত হচ্ছে।
সমাধানের পথ
বাংলাদেশ রাজনৈতিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার বন্দী হতে পারে না। অস্থিরতার চক্র ভাঙার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ জরুরি:
1. বিশ্বস্ত নির্বাচন ও প্রয়জনীয় সংস্কার – গনদাবী হচ্ছে প্রতিনিধিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা তারপর স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণসহ নির্বাচনের সময়রেখা নির্ধারণ করা।
2. আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা – নিরাপত্তা বাহিনী পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করবে, নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
3. অর্থনৈতিক সংস্কার – ডিফল্ট ঋণ সমাধান, FDI আকর্ষণ, এবং RMG শ্রমিকদের সুরক্ষা।
4. সামাজিক সুরক্ষা – সংখ্যালঘু, সাংবাদিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী রক্ষা করা, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন।
5. সংস্কার বিহীন নির্বাচন - সমাজে আগের মতো অস্থিরতা সৃষ্টি করবে যাহা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে ।
6. সংস্কারের এখনই সময় - এই সময় যদি প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত সংস্কার না করা যায় তাহলে আগামীর রাজনীতিতে নতুন নতুন সমস্যার জন্ম হবে এবং রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে ।
7. রাজনৈতিক স্বার্থপরতার- এই দেশের গনমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূল প্রতিবন্ধকতা। তাই এই সরকারের রাজনৈতিক দলের বাঁধার উধ্বে’ উঠে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্কার করা জরুরি কত’ব্য।
উপসংহার
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার ধ্বংসাত্মক প্রভাব কেবল অস্থায়ী ব্যাঘাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলার ভিত্তিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০২৪ সাল থেকে এই অস্থিরতা ইতিমধ্যেই প্রবৃদ্ধি ধীর করেছে, দারিদ্র্য বাড়িয়েছে, এবং দেশের খ্যাতি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি স্বার্থপরতার বাইরে না গিয়ে সংস্কার গ্রহণ না করে, বাংলাদেশ আরও গভীর ও বিপজ্জনক সংকটে পতিত হবে।
একটি সম্ভাবনাময় দেশ এবং প্রাণবন্ত জনগণের জন্য, অ্যাকশনের বিলম্বের মূল্য অত্যন্ত বেশি। ন্যায়সঙ্গত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থিতিশীল সংস্কারের সময় এখনই—না হলে কখনও নয়। লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।