প্রতারণার গণভোট: ড. ইউনূসের দ্বৈত নির্বাচনের ফাঁদে রাষ্ট্রীয় সংস্কার আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সংকট

Sadek Ali
এম. এ. মাতিন
প্রকাশিত: ১:৫৬ অপরাহ্ন, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৯:৩১ পূর্বাহ্ন, ২৮ নভেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব ছিল এক অনন্য ঘটনা। জনগণ তখন রাস্তায় নেমেছিল মুখ বদলের জন্য নয়, বরং ব্যবস্থা বদলের জন্য—একটি দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য। জনগণের দাবি ছিল স্পষ্ট—সংস্কার চাই, দলীয় শাসন নয়।

কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন যেন এক গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন ঘোষণা দিলেন যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে, তখনই গোটা জাতি স্তব্ধ হয়ে গেল। জনমনে এখন তীব্র সন্দেহ—এই সিদ্ধান্ত আসলে জনগণের সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে ধ্বংস করে বিএনপি-প্ররোচিত এক রাজনৈতিক নাটকের অংশমাত্র।

আরও পড়ুন: দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, ‘ত্যাগ, নির্যাতন ও আপোষহীনতার অনন্য প্রতীক’

একই দিনে দুটি ভোট—একটি রাজনৈতিক প্রহসন:-

একই দিনে দুটি ভিন্ন প্রকৃতির ভোট—একটি সরকারের গঠন নির্ধারণ করবে, অন্যটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নির্ধারণ করবে—এমন সিদ্ধান্তের তুলনা হতে পারে না কোনো গণতান্ত্রিক দেশে।

আরও পড়ুন: বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে বন্দর চুক্তি: জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রয়োজন দূরদর্শী বাস্তবতা

এটি নিছক প্রশাসনিক অদূরদর্শিতা নয়, বরং একটি কৌশলগত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য জনগণের রায়কে বিভ্রান্ত করা, সংস্কার আন্দোলনকে দুর্বল করা।

গণভোট মানে জনগণের নীতিগত মতামত—সংবিধান সংস্কার, রাষ্ট্রীয় ভারসাম্য, বিচার বিভাগ, প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে জাতির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন মানে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্ষমতার লড়াই।

এই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়া একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলে জনগণের মতামত অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়বে—যা গণতন্ত্রের অবমাননা এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।

প্রশাসনিকভাবে অসম্ভব, রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক:-

বাংলাদেশের ভোটের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটি সাধারণ নির্বাচনই দেশে সংঘর্ষ, অনিয়ম ও জাল ভোটে জর্জরিত হয়। এখন যদি একই দিনে দুটি ব্যালট, দুটি হিসাব, দুটি রাজনৈতিক এজেন্ডা একত্র হয়, তাহলে ভোটের শুদ্ধতা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

একই কেন্দ্রে দুটি ব্যালটবাক্স, দুটি গণনার প্রক্রিয়া, দুটি ভোটার লাইন—এই বিশৃঙ্খলার সুযোগেই ঘাপটি মেরে থাকা পুরনো দখলবাজরা সক্রিয় হয়ে উঠবে।

ফলাফল হবে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এবং জনগণের রায় বিকৃত করার নতুন ষড়যন্ত্র।

ড. ইউনূস ও বিএনপির গোপন আঁতাতের অভিযোগ:-

ড. ইউনূস যে ক্রমশ বিএনপির নেপথ্য কণ্ঠে পরিণত হচ্ছেন, তা এখন প্রকাশ্য আলোচনার বিষয়।

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিল—নির্বাচন ও গণভোট ফেব্রুয়ারিতে একই দিনে করা হোক। অবশেষে ড. ইউনূস হুবহু সেই দাবি মেনে নিলেন।

এতে জনগণের মনে দৃঢ় ধারণা জন্মেছে—“বিএনপি মানে ড. ইউনূস, আর ড. ইউনূস মানে বিএনপি।”

জনগণ যে নিরপেক্ষতার আশায় তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, তিনি সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর অবস্থান এখন প্রশ্নবিদ্ধ, তাঁর নেতৃত্বে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব—এমন বিশ্বাস আর কেউ রাখছে না।

জুলাই বিপ্লবের চেতনা থেকে সরে যাচ্ছেন ড. ইউনূস:-

২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান শুধু রাজনৈতিক বিদ্রোহ ছিল না—এটি ছিল রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জনআন্দোলন।

জনগণ তখন বিশ্বাস করেছিল, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নোবেলজয়ী এই ব্যক্তি পুরনো দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রকে সংস্কারের পথে এগিয়ে নেবেন।

কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, ড. ইউনূস সেই মহান উদ্দেশ্যের বিপরীতে গিয়ে এক দুর্নীতিগ্রস্ত, সন্ত্রাসী ও দালালচক্রের স্বার্থ রক্ষা করছেন।

তিনি যেন সেই অন্ধকার শক্তিকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার পথ প্রশস্ত করছেন—যে শক্তি এই দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল।

কেন সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে:-

বাংলাদেশের সমস্যা শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়; সমস্যা হলো ব্যবস্থার পচন।

দল বদলালে মানুষ বদলায় না, কারণ কাঠামোই দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ।

এই কাঠামো বদলানোর জন্যই প্রয়োজন সংস্কার—

সংবিধান সংস্কার,

প্রশাসনের অরাজনৈতিকীকরণ,

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা,

স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন,

এবং দলীয় নিবন্ধনের কঠোর নীতি।

এই সংস্কারগুলোই জনগণের গণদাবি। আর সেই সংস্কারের পথেই ছিল গণভোটের আহ্বান।

কিন্তু ড. ইউনূস সেটিকে রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়ে তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করছেন।

সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানে পুরনো রাজনীতির পুনরাবৃত্তি—যেখানে দুর্নীতিবাজরাই জিতে যায়, আর সাধারণ মানুষ আবারও পরাজিত হয়।

নিরপেক্ষতার পতন:-

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের মূল দায়িত্ব ছিল জনগণের আস্থা ধরে রাখা।

কিন্তু বিএনপির ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তাঁর নিরপেক্ষ অবস্থান হারিয়েছেন।

আজ দেশের মানুষ প্রশ্ন তুলছে—

“তিনি কি সত্যিই জনগণের প্রতিনিধি, নাকি বিএনপির নিয়োগপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক?”

প্রশাসনের ভেতর থেকেও অভিযোগ উঠছে—অনেক কর্মকর্তা নাকি বাধ্য হচ্ছেন বিএনপি-ঘেঁষা নির্দেশনা অনুসরণ করতে।

যে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে, সেটি আর তত্ত্বাবধায়ক নয়—এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্সি প্রশাসন।

জনআকাঙ্ক্ষা বনাম ক্ষমতার খেলা:-

জনগণের যে বিপ্লবী চেতনা জুলাইয়ে দেখা গিয়েছিল, আজ সেটি বিপন্ন।

যে গণভোট জনগণের রায়ের প্রতীক হওয়ার কথা ছিল, সেটি এখন একটি ক্ষমতার খেলায় রূপ নিচ্ছে।

জনগণের দাবি ছিল—“আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন।”

কিন্তু ড. ইউনূসের পরিকল্পনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত—“আগে ভোট, পরে বিশৃঙ্খলা।”

জাতির দায়িত্ব এখন জনগণের হাতে:-

আজকের বাংলাদেশ আবার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

ড. ইউনূস যদি সত্যিই জনগণের প্রতিনিধি হতে চান, তবে তাঁকে অবিলম্বে—

১. গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনকে আলাদা তারিখে ঘোষণা করতে হবে।

২. রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার নবায়ন করতে হবে।

৩. প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে স্বাধীন নাগরিক কমিটি গঠন করতে হবে।

৪. জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ আয়োজন করতে হবে।

এগুলোই হলো সংস্কারের প্রথম শর্ত। অন্যথায়, তিনি নিজের হাতে জনগণের আশাকে ধ্বংস করবেন।

উপসংহার: বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কোনো বিদেশি শক্তির নয়, কোনো দলেরও নয়—এটি জনগণের।

যে নেতা জনগণের ইচ্ছাকে অমান্য করে দলীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়, সে জনগণের নয়—সে দেশের শত্রু।

আজ জাতি আবারও প্রতারিত বোধ করছে।

ড. ইউনূসের এই সিদ্ধান্ত জনগণের মুক্তিকামী আন্দোলনের প্রতি এক গভীর বিশ্বাসঘাতকতা।

তিনি যদি এই পথেই এগিয়ে যান, তবে জনগণই একদিন তাঁর জবাব দেবে—শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ়ভাবে।

কারণ, সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন নেই, নিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র নেই, আর জনগণের রায় ছাড়া কোনো নেতা বৈধ নয়।

বাংলাদেশ এখন আর রাজনৈতিক নাটক চায় না;

চায় সত্যিকারের পরিবর্তন,

চায় সংস্কার,

চায় ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা,

যেখানে কোনো ইউনূস বা বিএনপি নয়, বরং জনগণের ইচ্ছাই হবে সর্বোচ্চ আইন।