অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে বিরোধী পক্ষ দমন করছে: এইচআরডব্লিউ

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ও তাদের কথিত সমর্থকদের গ্রেফতার করছে। সংস্থাটি বলেছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের উচিত অবিলম্বে নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া এবং সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে উৎসাহিত করা।
নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসে। তার আগে টানা কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।
আরও পড়ুন: ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবন সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা
এরপর ২০২৫ সালের ১২ মে সরকার সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের নতুন বিধান ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে দলটির সভা-সমাবেশ, প্রকাশনা ও অনলাইন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি, এই আইন এখন আওয়ামী লীগ ও শান্তিপূর্ণ কর্মীদের গ্রেফতারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সংস্থাটির এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেন শেখ হাসিনার আমলের মতোই দলীয় দমননীতি অনুসরণ না করে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে ভরা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত: ট্রাইব্যুনালের অভিমত
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে দ্রুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেফতার ঠেকাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এখন পর্যন্ত হাজারো মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, আবার অনেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আটক রয়েছেন। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে হেফাজতে নির্যাতন ও চিকিৎসা বঞ্চনার অভিযোগ করেছেন।
গত ২৮ আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে ১৬ জন সাংবাদিক, অধ্যাপক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
প্রথমে পুলিশ জানায়, তাদের নিরাপত্তার জন্য আটক রাখা হয়েছে। পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দিয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে একই মামলায় আরও দুজনকে আটক করা হয়।
একজন পরিবারের সদস্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “ওটা ছিল কেবল একটি আলোচনা সভা, রাজনৈতিক সমাবেশও না। তাহলে এটাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হচ্ছে কীভাবে? যারা হামলা চালিয়েছে তারা মুক্ত, আর যারা আক্রান্ত হয়েছে তারা জেলে।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি প্রণয়ন করে। ২০২৫ সালে ইউনূস সরকার আইনটিতে সংশোধন এনে বলে, আওয়ামী লীগের সময়কার অপব্যবহারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতেই এই পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থা ও সম্পাদক পরিষদ বলছে, আইনটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে।
সরকার একই সঙ্গে ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর সহিংস কর্মকাণ্ডও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫২ জন নিহত হয়েছেন।
এক রাজনৈতিক কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “এখন আমাদের সামনে দুটি পথ— হয় সন্ত্রাসী বলে জেলে যেতে হবে, না হয় জনতার হাতে মরতে হবে। আমি বলছি না অপরাধীদের ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু বিচার যেন ন্যায্য হয়— যা ইউনূস সরকারের পক্ষে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয় ও বাংলাদেশ সরকার চলতি বছরের জুলাইয়ে তিন বছরের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এতে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও একটি মিশন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। সরকার জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে রাজনৈতিক দমননীতির নতুন হাতিয়ার না বানায়, বরং নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।