জুলাই সনদ: যাদের রক্তে লেখা ইতিহাস, তাদেরই বাদ দেওয়া কেন?

“রাষ্ট্র যখন মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই জুলাই যোদ্ধাদেরও অবহেলার পথে ঠেলে দিচ্ছে” ২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর — আজকের দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণীত হলো “জুলাই সনদ”, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র এক নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর ঘোষণা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: এক রক আইকনের গল্প
কিন্তু একদিকে যখন রাজধানীর অভিজাত মঞ্চে উড়ছে উৎসবের পতাকা, তখন অন্যদিকে রাজপথে বাজছে লাঠির শব্দ, ছুটছে কাঁদানে গ্যাস, ঝরছে রক্ত।
যাদের ত্যাগে এই সনদের জন্ম, তারাই আজ সেই সনদ থেকে বাদ — এক নির্মম বৈপরীত্য, এক রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের তিন-শূন্য তত্ত্ব: বৈশ্বিক স্লোগান, জাতীয় নীরবতা
যাদের রক্তে সনদের জন্ম, তাদেরই মুখ বন্ধ করা হলোঃ-
গত বছরের জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন গণজাগরণের সূচনা করেছিল।
স্বৈরাচার, দলীয় দমননীতি ও প্রশাসনিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ—ছাত্র, শ্রমিক, নারী, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রবাসী—রাজপথে নেমেছিল এক নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নে।
কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, সেই আন্দোলনের ফলাফল যাদের আত্মত্যাগে সম্ভব হয়েছিল, তারাই জুলাই সনদের প্রণয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছেন।
তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই, কোনো মতামত প্রতিফলিত হয়নি, এমনকি তাদের নিরাপত্তা বা পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি।
আরও অবিশ্বাস্য হলো— জুলাই যোদ্ধাদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি “জুলাই সনদ” স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে!
যাদের ত্যাগে এই সনদের জন্ম, তাদেরই বাদ দিয়ে সরকার নিজেরাই উদযাপন করেছে সাফল্যের উৎসব। এর চেয়েও লজ্জাজনক ও অমানবিক দৃশ্য ঘটেছে ঢাকার রাজপথে—আহত এক জুলাই যোদ্ধাকে পিটিয়ে তার কৃত্রিম হাত ভেঙে ফেলা হয়েছে, আর বিক্ষোভরত যোদ্ধাদের কুকুরের মতো পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এ দৃশ্য শুধু নির্মম নয়, জাতির জন্য এক অপমানজনক অধ্যায়—
এই জাতি আজ আবার প্রমাণ করলো, আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি, যারা রক্তে ইতিহাস লেখে, তাদেরই ভুলে যাই ক্ষমতার মায়ায়।
জুলাই সনদ: জনগণের, না ক্ষমতার?
সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একে বলছে “জনগণের সনদ”। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—জনগণ কোথায়?
সনদ প্রণয়নের সময় কোনো গণশুনানি হয়নি, কোনো গণভোট হয়নি, এমনকি আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের সাথেও কোনো আলোচনা হয়নি। তাহলে কেমন করে এটি “জনগণের সনদ”?
এটি আসলে এক প্রশাসনিক সমঝোতার দলিল, যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী নিজেদের বৈধতা প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছে।
যে সনদে নেই স্বাধীন তদন্ত কমিশন, দায়মুক্তি আইন, আন্দোলনকারীদের পুনর্বাসন, বিচারিক স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নাগরিক সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি—সেই সনদ কখনোই জনগণের হতে পারে না।
রাষ্ট্রের সহিংস মনোভাব ও নৈতিক পরাজয়ঃ-
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
রাজপথে বিক্ষোভে নেমে আসা জুলাই যোদ্ধাদের ওপর লাঠিচার্জ, গুলি ও গ্রেপ্তারের ঘটনা রাষ্ট্রের সহিংস চরিত্রকে আরও উন্মোচন করেছে।
তাদের শরীরে আঘাত পড়েছে, কিন্তু তাদের কণ্ঠের আগুন নিভে যায়নি।
যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাষ্ট্রকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতজানু করতে বাধ্য করেছিল, আজ তারাই রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার।
যদি রাষ্ট্র সত্যিই গণতান্ত্রিক হতে চায়, তবে প্রথম শর্ত হলো—বিরোধী কণ্ঠের প্রতি সহনশীলতা।
কিন্তু সরকার আবারও সেই পুরনো দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছে, যেখান থেকেই জুলাই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে “জুলাই সনদ” ইতিহাসে হয়তো “জুলাই প্রহসন” নামেই পরিচিত হবে।
কারা এই জুলাই যোদ্ধা, এবং তাদের দাবিগুলো কী?
জুলাই যোদ্ধারা কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল নয়।
তারা হলো সেই সাধারণ মানুষদের দল, যারা রাষ্ট্রীয় দমননীতি, দলীয় আধিপত্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমেছিল।
তাদের প্রধান তিনটি দাবি ছিল—
- রাজনৈতিক দায়মুক্তি ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা,
- পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ,
- জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের ভিত্তিতে গণভোট ব্যবস্থা।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, জুলাই সনদে এই মৌলিক দাবিগুলোর কোনো প্রতিফলন নেই।
এমনকি সনদের প্রস্তাবনায় “জুলাই আন্দোলনের অবদান” শব্দগুচ্ছও ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে—
যা আন্দোলনকারীদের কাছে এক চরম অপমান।
ক্ষমতার রাজনীতি বনাম জনগণের রাজনীতিঃ-
বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক, জনগণকেন্দ্রিক নয়।
জুলাই সনদের রচনাপ্রক্রিয়াতেও সেই একই পুরনো প্রবণতা দেখা গেছে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণি ও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা—এই তিন শক্তির মেলবন্ধনেই তৈরি হয়েছে সনদের কাঠামো।
অন্যদিকে, আন্দোলনের মাটির মানুষদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে।
এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, এক নৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা—
যেখানে জনগণের রক্তকে ব্যবহার করা হয়েছে বৈধতার পুঁজি হিসেবে, কিন্তু তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নির্দ্বিধায়।
সনদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে জনগণের সম্পৃক্ততার ওপরঃ-
জুলাই সনদ টিকবে কি না, তা নির্ভর করছে জনগণের স্বীকৃতি ও অংশগ্রহণের ওপর। যদি সরকার সত্যিই সংস্কারের পথে হাঁটতে চায়, তবে এখনই সময় জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে সংলাপে বসা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সনদে জনগণের মতামত যুক্ত করা।
নচেৎ এই সনদও পরিণত হবে আরেকটি “চুক্তি-রাজনীতির” কাগুজে দলিলে—যার কোনো নৈতিক বা গণতান্ত্রিক ভিত্তি থাকবে না।
শেষ কথাঃ ইতিহাস ভুলে গেলে ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়
“জুলাই সনদ” কেবল একটি প্রশাসনিক দলিল নয়; এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় গণজাগরণের প্রতীক। যদি এই সনদ জনগণের স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের প্রতিফলন না ঘটাতে পারে, তবে তা হবে ইতিহাসের প্রতি এক ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা। জুলাই যোদ্ধারা লড়েছিলেন এমন এক বাংলাদেশের জন্য, যেখানে কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠী নয়—জনগণই হবে সিদ্ধান্তের মালিক। সেই আদর্শ যদি আবারও ক্ষমতার টেবিলের নিচে চাপা পড়ে যায়, তবে ভবিষ্যতের আন্দোলন হবে আরও বিস্ফোরক, আরও অনিবার্য। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জুলাই সনদকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে একটিই সত্য স্বীকার করতে হবে— যাদের রক্তে এই সনদের জন্ম, তারাই এর প্রকৃত মালিক।
এম এ মাতিন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক