নবী উল্লাহ নবীর সেল্টারে ডেমরায় বেপরোয়া জামান-সেলিম

Sanchoy Biswas
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ৪:৪৯ অপরাহ্ন, ১৩ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ৪:৪৯ অপরাহ্ন, ১৩ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

রাজধানীর ডেমরায় দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দলবাজি, জমি দখল, খুন-জখমসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি এবং সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে রয়েছে ভয়াবহ অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, তারা জমি দখল করে আদায় করছে মুক্তিপণ, মামলা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ, এমনকি নিরীহ মানুষদের ওপর চালাচ্ছে নির্যাতন ও নিপীড়ন।

অনুসন্ধানে উঠে আসে, যাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও মামলা-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, তারা সবাই বিএনপি নেতা নবী উল্লাহ নবীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী। এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে বা প্রতিবাদ করার সাহস দেখালে তার উপর নেমে আসে ভয়াবহ নিপীড়ন ও নির্যাতন। ফলে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এলাকাবাসী।

আরও পড়ুন: সাদা পাথর রক্ষায় প্রশাসনের ৫ দফা সিদ্ধান্ত

আনিসুজ্জামান ওরফে জামান ও সেলিম রেজা ওরফে সেলিম—স্থানীয়ভাবে 'জামান-সেলিম' নামে পরিচিত এই দুজন ব্যক্তি এলাকার সব স্কুল কমিটিতে হস্তক্ষেপ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের নির্দেশনা ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কখনো হুমকি, কখনো মারধর—এসব তাদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা বলেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ডেমরায় ইখলাক খান রুদ্র (পিতা: মৃত মহিউদ্দিন খোকন), কাইলা সোহেল (পিতা: শ্যামল), সুজাত (পিতা: অজ্ঞাত), ইমন (পিতা: শাহীন), আব্দুল্লাহ (পিতা: অজ্ঞাত), আকাশ (পিতা: বাবুল), সাজিত (পিতা: কালাম), হাফেজ (পিতা: নুরুল আমিন), সাফওয়ান হোসেন রিফাত (পিতা: মৃত শহিদুল ইসলাম) এবং বাদশা ঢালী (পিতা: মৃত দুলাল ঢালী)—এই সংঘবদ্ধ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছে।

আরও পড়ুন: ‎পাবনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে সুযোগ নিয়ে এই চক্রটি রাজনৈতিক পালাবদলের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। অভিযোগ রয়েছে, একসময় তারা ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মী ও পদধারী নেতা। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিএনপির কতিপয় স্বার্থান্বেষী নেতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় রাজনীতিতে এদের অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে উঠেছে প্রশ্ন—এরা কি আওয়ামী লীগের, না বিএনপির পালিত গুণ্ডাবাহিনী? এদের অপরাধপ্রবণতা এতটাই বিস্তৃত যে কেউ মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছে। কারণ, যেখানে পুলিশের ভূমিকাই নিষ্ক্রিয়, সেখানে নিরাপত্তা প্রত্যাশা শুধু দুরাশা। এমনকি পুলিশ সদস্যরাও এদের হামলার শিকার হচ্ছেন।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি (২০২৫) বৃহস্পতিবার বিকেলে ডেমরার সারুলিয়া ওয়াসা রোড এলাকায় মাছের খামারি রেজাউল হক (৩৬) সন্ত্রাসীদের বেধড়ক মারধরের শিকার হন। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশের সারুলিয়া ফাঁড়ির সদস্য জুয়েল রানা হামলার শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, ইখলাক খান রুদ্র ও সুজাতের নির্দেশে কাইলা সোহেল লোহার শিকল দিয়ে জুয়েল রানার মাথায় আঘাত করে। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং গুরুতর আহত হন।

চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার পর রাতেই ডেমরা থানায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। একটি মামলা রুজু হয় ২৪ নম্বর হিসেবে (তারিখ: ২৭/০২/২০২৫), যার ধারা: ১৪৩, ৩৩২, ৩৩৩, ৩০৭, ৩৫৩ ও ১১৪। ওই ঘটনায় রুদ্র বাহিনীর দুই সদস্যকে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত বাদশা ঢালী ও সাফওয়ান হোসেন রিফাতকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় বিএনপি নেতা জামানের ছত্রছায়ায় মামলাবাজির রাজত্ব কায়েম করেছে এক ব্যক্তি, মুকুল। তিনি অবৈধভাবে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে অর্থ আদায় করছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক খালিদ মাসুদকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করেন এবং অর্থ আদায় করেন।

৭ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে, এই মামলা-বাণিজ্যের মূলে রয়েছে বিএনপির ডেমরা থানা কমিটির প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক জামান। তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ প্রতারণা সিন্ডিকেট। এ চক্র গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোতেও নিরীহদের আসামি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

এক কল রেকর্ড বিশ্লেষণে উঠে আসে, বিএনপি নেতা জামান নিজেই বলেছেন, “আইনের তো দরকার নাই, মামলা থেকে খালাস চাইলে দেখা করলেই হবে।” একইভাবে মামলাবাজ মুকুল বলেন, “আমার গডফাদার জামানের সাথে দেখা করলে মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব।”

এদিকে হাজী মোয়াজ্জেম আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসতাব উদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, “আমি ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও আমাকে নিজ কক্ষে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বরং আমাকে আটকে রাখা হয়, দেওয়া হয় জীবননাশের হুমকি। রাস্তাঘাটে দেখলেও আমার ওপর হামলার চেষ্টা করা হয়। আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় ব্যর্থ হয়ে তারা আমাকে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “মূলত আমাকে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং পুরো প্রতিষ্ঠান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্যই তারা এসব করছে। আমার নামে অপবাদ ছড়ানো, মিথ্যা অভিযোগ দাখিল, এমনকি বাকি সহকারী শিক্ষকদেরকেও হুমকি দিয়ে মিথ্যা বক্তব্য বা অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে।”

এছাড়াও সারুলিয়া কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণও জামান-সেলিমের হাতে। সম্পূর্ণ কালেকশন তারাই তাদের লোকজন দিয়ে করে। ময়লার কালেকশন করে মোশাররফের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩৭,০০০ টাকা করে নেয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু বলেন, “অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত নই। আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, তদন্তসাপেক্ষে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিএনপিতে চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই। তবে কেউ যদি বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ডেমরা-যাত্রাবাড়ী এলাকার বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবী বলেন, “একটি পক্ষ আমার লোকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, আমি এ সম্পর্কে কিছু জানি না। তবে বিএনপিতে চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই।”

এই ভয়াবহ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা চাঁদাবাজি-মামলা-বাণিজ্যের জালে জর্জরিত সাধারণ মানুষ। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে দিনদুপুরে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এখন সময় এসেছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব স্বার্থ ভুলে এই অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার।