স্থানীয় প্রশাসন ভাগ বাটোয়ারা পেয়ে নির্বিকার ছিল
সাদাপাথর খেকুরা শনাক্ত, শীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা

সিলেটের ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দুর্বৃত্তদের সনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা। দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা থেকে একাধিক গোয়েন্দা টিম এলাকা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ও স্থানীয় পাশ ও পাথর ব্যবসায়ীরা এই লুটে জড়িত। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বাগ বাটোয়ারা ছিল পাথর লুটকারীদের।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে পাথর লুটের ঘটনায় অভিযানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিম। রাষ্ট্রীয় পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন ও লুটের অভিযোগে এ অভিযান পরিচালিত হয়।
আরও পড়ুন: সাভারে পাচারকালে পিকআপসহ সাড়ে ৬ লাখ টাকার টিসিবি’র পণ্য জব্দ, আটক-১
বুধবার বেলা দুইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি দল পরিদর্শন করে দোষীদের শনাক্তের কাজ শুরু করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ।
অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে কয়েক শ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় খনিজ সম্পদ তথা পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অভিযান চালায়। প্রাথমিকভাবে তাঁরা এ অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। এ লুটপাটে কারা সম্পৃক্ত ছিলেন, সেটাও তাঁরা শনাক্ত করার কাজ করছেন।
আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে ১ নিহত, শতাধিক আহত
দুদকের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস্ সাদাৎ প্রথম আলোকে বলেন, লুটপাটে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রভাবশালী লোক, পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জড়িত ছিলেন। তাঁদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো নিষ্ক্রিয় ছিল বা বাধা দেয়নি। এ কারণে এ লুটপাট ঠেকানো যায়নি বলে দুদক জানতে পেরেছে। অভিযান শেষে দুদক পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।
দুদক সূত্র জানায়, দুদক দল সরেজমিনে দেখতে পায়, ঘটনাস্থলে স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন সেবা চালু আছে। নদীর তীরেই বিজিবি ক্যাম্প এবং বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। বছরখানেক সময় ধরে প্রশাসনের সামনে এবং স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় পাথর উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাথর চুরির প্রক্রিয়াটি প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় সংঘটিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। সেই পাথর স্থানীয় পাথর ভাঙার (স্টোন ক্রাশার) যন্ত্রে ভাঙা হয়েছে, যাতে চুরি করা পাথরের অস্তিত্ব না পাওয়া যায়।
এদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাদাপাথর ও আশপাশের এলাকায় অভিযান শুরু হয়। বেলা সাড়ে চারটা পর্যন্ত এ অভিযান অব্যাহত ছিল। এ সময় সাদাপাথরের পাশের কালাইরাগ এলাকা থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। এসব পাথর আবার সাদাপাথরে রাখার প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া কলাবাড়ি এলাকায় পাথর ভাঙার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহার বলেন, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে অভিযান চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন। অভিযানে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সহায়তা করছে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় যতটুকু পর্যন্ত সেনাবাহিনী যেতে পারে, তারা ততটুকু পর্যন্ত গেছে।
একইভাবে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের বল্লাঘাট, ঝুমপাহাড় ও জিরো পয়েন্ট এলাকাতেও আজ বেলা একটা থেকে চারটা পর্যন্ত অবৈধ পাথর ও বালু উত্তোলন ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার পলি রানী দেব।
অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযানে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত ১০০টি বারকি নৌকা ভেঙে ফেলা হয়। পাশাপাশি অবৈধভাবে উত্তোলন করা ১৩০ ফুট বালু জব্দ করা হয়।
এর আগে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২০ সাল থেকে সরকারি নির্দেশনায় বন্ধ থাকা সিলেটের সব কটি পাথর কোয়ারিতে গণলুট শুরু হয়। কয়েক হাজার পাথরশ্রমিক প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন শুরু করেন। বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ লুটপাট চলে বলে অভিযোগ। তখন অন্যান্য পাথর কোয়ারিতে গণলুট চললেও তুলনামূলকভাবে পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে লুটপাট কম হয়। তবে গত ২৩ এপ্রিল থেকে সাদাপাথর এলাকায় আবার পাথর লুট শুরু হয়। গত এক সপ্তাহ দেদার লুটপাট চালিয়ে এলাকাটির প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর তুলে ফেলা হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে ধলাই নদীর উৎসমুখেই সাদাপাথরের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে এ পর্যটনকেন্দ্র। ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলের স্রোতোধারা এ পর্যটনকেন্দ্রের মূল আকর্ষণ। এই সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের কয়েক হাজার পর্যটক ভিড় জমান। এখন পাথর লুট হয়ে যাওয়ায় পর্যটকেরা হতাশ।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা পরিদর্শন করে গোপনীয় প্রতিবেদন প্রদান করছে। দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে আশপাশের ভিডিও ফুটেজ এবং ট্রাক ভরে সাদা পাথর পরিবহনের ভিডিও সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
গত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জের সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই সাদা পাথর লুটে জড়িতদের সবাই চেনে। রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সন্ত্রাসী দুর্বৃত্তরা প্রভাব দেখিয়ে প্রকাশ্যে পাথরগুলি বিক্রি করে দেয়। স্থানীয় প্রশাসন এটি দেখেও দায়সারা অভিযান ও দায়িত্ব পালন করেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বিশেষ করে উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি বিভাগের সাথে তাদের বাগবাটোয়ারা সম্পর্ক ছিল। পাথর উত্তোলনে সপ্তাহ ভিত্তিক বাগবাটোয়ারা হত। সকলকেই চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দারা। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।